১৯৭১ নাকি ২০২৪? স্বীকার-অস্বীকারের প্রশ্ন!

 



২৪ কে ধারণ করলে সে নাকি ৭১ কে অস্বীকার করার শামিল, আর যারা ৭১ কে স্বীকার করে তারা নাকি ২৪ এর গণ-বিপ্লব মানতে পারে না!


আমি সবসময় একটি কথাই বলি, জাতি গত ভাবে আমাদের মানুষিক মূল্যবোধের অনেক ঘাটতি রয়েছে। একটা বিলাপ প্রায়ই শোনা যায়, দেশ সবাধীনের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে তাও আমরা একটি উন্নত দেশে পরিণত হতে পারিনি। যখন যে ক্ষমতায় এসেছে তারাই দেশটাকে চুষে খেয়েছে আর কেউ দেশকে বিক্রি করে দিয়েছে।


কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই তাই?

একটা দেশ-সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের উন্নতি কি শুধুই ক্ষমতার মসনদে যারা বসে তাদের দ্বারাই হয়? ধরুন আপনি আপনার নিজের জামিতে একটি বাড়ি নির্মাণ করছেন। আপনি যদি এলাকায় ক্ষমতাশালী কিংবা ক্ষমতাশালীদের সংস্পর্শে থাকা ব্যাক্তি না হোন তাহলে সঠিক নিয়ম মেনে জায়গা ছেড়ে বাড়ি নির্মানের নকশা তৈরী এবং কাজ শুরু করলেও দেখবেন বিভিন্ন স্থান থেকে আগমন ঘটবে বিভিন্ন রকম রক্ত চোষা জোঁকের। নানান বাধা আর হয়রানি করে আপনার আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিবে কয়েক বছর। এখন যেসব জোঁকের আগমণ ঘটবে তারা কি সরাসরি ক্ষমতায় মসনদে থাকা ব্যাক্তির হুকুমে এসেছে? মোটেও তা না। তারা আপনার এলাকার, আপনারই আশেপাশের মানুষ, আপনারই প্রতিবেশী। তারা আপনার উন্নতি সহ্য করতে পারে না, তারা চায় না আপনি সমৃদ্ধ হোন। আপনার হাতে যে পয়সার গন্ধ তারা পেয়েছে তার লোভে তাদের জীভে জল এসে পরে। এখন এই শিক্ষা কি রাষ্ট্র তাকে দিয়েছে? না, মোটেও তা নয়। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তাদেরকে এমন মানুষরূপী লেবাসধারী পশুতে পরিণত করেছে। গত ১৫-১৬ বছর দেশের পরিমন্ডলে যে বিষয়গুলো খুব বেশী লক্ষ করতাম তার মধ্যে অন্যতম ছিলো দেশের টিনেজার ছেলে-মেয়েদের রাজনৈতিক ছত্র-ছায়া প্রীতি এবং একশ্রেণীর মধ্যবয়সী কিংবা তদোর্দ্ধ মানুষগুলোর রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা ছত্র-ছায়ার পরিচিতি দিয়ে মসজিদ কমিটি কিংবা লোকাল বিভিন্ন কমিটিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরী। 


একটি সমাজ এবং রাষ্ট্র তখনই উন্নতির পথে হাটে যখন সে সমাজের সিনিয়র সিটিজেনরা নিজেদের জীবণের ভূল ভ্রান্তি গুলোকে উপলব্ধী করে এবং তাদের সন্তানদের সে ভুল গুলো থেকে দূরে রাখার জন্য সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকে। কিন্তু আমাদের সমাজের চিত্র ছিলো পুরোটাই ভিন্ন। সন্তান রাজনীতির সংস্পর্শে এসে অনৈতিক পথে অর্থ, ক্ষমতা, নাম কামাইতে শুরু করলে পিতারা সেটা নিয়ে গর্ববোধ করেছে। এবং প্রয়োজনে সন্তানের নাম ভাঙ্গিয়ে তারাও নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে গেছে। 


এই ক্ষমতা, অর্থ আর নিজেদের নাম প্রতিস্থাপনের লোভ কি এই দুইটা জেনারেশনের মাথায় সরকার নিজে এসে ঢুকিয়ে দিয়েছে? কোন সরকারেরই সে ক্ষমতা নেই। তবে বিগত সরকার যেটা করেছে, তারা দেশের মানুষদের ব্যাপারে বিদেশী শক্তির সহায়তায় নিবির পর্যালোচনা করেছে। দেশের মানুষ কোনটা খাবে আর কোনটা লুফে নিবে তা বোঝার চেষ্টা করেছে। বিগত সরকার খুব ভালো করেই অনুভব করেছিলো যে এই দেশের একটি বড় অংশ আসলে রাষ্ট্রের উন্নতি নয়, তারা নিজের একক উন্নতি চায়। রাষ্ট্রের কি এলো গেলো তাদের সে ব্যাপারে কোন কিছু যায় না। আর এই বড় অংশকে তারা পরবর্তিতে রাজনীতির সংস্পর্শে রেখে এবং প্রশাসনিক সহায়তা দিয়েছে। এর মূল কারণ, এরা রাস্তার কুকুরের ন্যায়। যত্ন-আত্মি কিছুই করতে হবে না। শুধু সন্ধ্যায় একবার একটু রুটি ছিটালে কিংবা পচা ভাত খাইতে দিলেই এরা দারোয়ান, নাইটগার্ডদের পেছনে বছরে যে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয় তা আত্মসাৎ করা খুবই সহজ হবে। এরা জানবেও না, এদেরকে সামনে রেখে কত বড় বড় ক্রাইম করা হচ্ছে। আর যদি কেউ বুঝতে পারে, তাদের মাঝে তো মুল্যবোধ নেই, তাই কেউ কোন প্রতিবাদও করবে না। 


বিগত এক যুগেরও বেশী সময় ধরে যে জাতির মস্তিষ্কে লেজুর ভিত্তিক রাজনীতির সুফল সীসার মতন ঢেলে দেওয়া হয়েছে সে জাতি কি এতো দ্রুত উন্নতির গান গাইতে পাড়বে? তাদের কাছে উন্নতি মানেই তো-


“পরের ধনের উপর আপন মন, সদা জাগরণ।”


আমাদের মাঝে এই নোংরা মূলবোধ এখনও জাগ্রত। জাগ্রত বলেই, গত এক যুগেরও বেশী সময় ধরে এই দেশের বুকে ঘটা অন্যায়, অত্যাচার, পরোক্ষ ভাবে দেশ বিক্রি, গুম, খুন, অর্থ জালিয়াতি, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ধ্বংস, সংবিধানের কারচুপি, বিচার বিভাগ ধ্বংস কোন কিছুই আমাদের চোখে পড়ে না। সেসব বাদই দিলাম, এখনও পুরো একবছর হয়নি। সাধারণ মানুষদের উপর রাস্তায়, ছাত্রদের উপর যে বর্বর হত্যা যোগ্য চালানো হয়েছে সেসব আমরা ভুলে গিয়েছি। জুলাই গণহত্যা, ৬ মে শাপলা চত্বর গণহত্যা, পিলখানা গণহত্যা কোন কিছুই আমাদের মনকে নাড়া দেয় না। আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধে দ্বিমত হয়ে যত মানুষকে সরব হতে দেখছি, পিলখানা আর শাপলা চত্তরের গণহত্যা নিয়ে তো তেমন সরব ছিলো না তারা? শুধু তাই নয়,কুরুচিপূর্ণ ব্লগারদের হত্যা নিয়ে তারা যতটা সরব ছিলো, দেশে তো তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশী আলেম এবং ইসলামকে অন্তরে লালন করা মানুষদের হত্যা করা হয়েছে, কই তখন তো সরব হয়নি কেউ? একজন ব্লগারকে হত্যা করা ব্যাপারটা আমি ব্যাক্তিগত ভাবে সাপোর্ট করিনা। কেননা, কোন ব্যাক্তি রাষ্ট্রের সংবেদনশীল বিষয়ে অস্থিতশীল পরিবেশ তৈরীর চেষ্টা করলে তার বিচার করবে রাষ্ট্রের সরকার। সে ব্লগার হোক কিংবা কোন ধর্মীয় আলেম কিংবা গুরু হোক।


আমাদের দেশে ইসলামোফোবিয়া যে বেশ বড়সড় ভাবেই দানা বেধেছে সেটা এখন open truth.ইসলামের কথা শুনলেই আমাদের ভয় করে। আর এই দেশে যদি ইসলামি আইনে চলতে থাকে, ওরে বাবা! এই যে রাস্তায় ওপেনে বিড়ি সিগারেট খাচ্ছি, মদের বারে যাচ্ছি, চিপায় বসে গঞ্জিকা সেবন করছি, মন চাইলেই নারীদের দেখছি, পতিতালয়ে যাওয়া যায়, লিভ টুগেদার করা যায়, বিয়ের চেয়ে লাভ আর সে*এক্স বেশী সহজ, বিয়ের পরে তালাক দেওয়াও সহজ, মেয়েরা দূরে দূরে একাই ভ্রমন করতে পারে, কয়েকজন বন্ধুর সাথে একজন বান্ধবী টুর দিতে পারে, কোন মাহরাম লাগে না। ঘুষ-দূর্নিতি করা যায়, চাঁদা বাজি করা যায়, বাজারে কাজির তদারকি নাই, ইচ্ছে মতন বাজার দর উঠা নামা করানো যায়, দুই নাম্বারি পণ্য বাজারজাত করে রাতারাতি শিল্পপতি হওয়া যায়, আরো অনেক কিছুই সহজে করা যায় তার সবই তো বন্ধ হয়ে যাবে দেশে ইসলামী শাষন ব্যাবস্থা চালু হলে। আর তাই ইসলামের কথা শুনলেই ভয় লাগে। কোথাও কাওয়ালীর অনুষ্ঠান হলেই আমাদের ভয়ে আত্মা শুকায়ে যায় (যদিও কাওয়ালি গানের সাথে ইসলামের সম্পৃক্ততা নেই), আন্দোলনে রাস্তায় নামাজের ওয়াক্তে নামাজের জামাত হলেই আমাদের ভেতর থেকে এক প্রকার ঘৃণার উদয় হয়, ওয়াজের আয়োজন শুনলেই আমাদের কানের ভেতরে বোঁ বোঁ করতে থাকে। কারণ একটাই, আমরা ইসলামকে ভয় পাই। 


একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধারার, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বর্ণের মানুষ থাকবে, যে যার নিজ নিজ ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতিনীতি প্রাক্টিস করবে, এটাই তো রাষ্ট্রের সৌন্দর্য্য। আর রাষ্ট্র সেখানে তার জনগণের রীতিনীতি পালনের স্বাধীনতা এবং সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিত করবে। এবং অপর দিকে কেউ যখন কট্টোর পন্থি মনোভাবে উপনীত হবে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকবে তাকে প্রতিহত করার, এবং বিশেষ প্রয়োজনে তাকে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেওয়া যেনো পরবর্তিতে কেউ সামাজিক শান্তি নষ্ট করতে না পারে, উস্কানি প্রদানে বাধা পায়। 


ধরেন, এক এলাকায় চার ধর্মানুসারী চার ব্যাক্তির বাড়ি আছে। এছাড়াও আছে একজন চিত্রশিল্পী, একজন গায়ক, একজন উকিল এবং একজন বংশীবাদকের বাড়ি। প্রতিদিন ভোরের আগে ফজরের আজান হয়, যিনি মুসলিম তিনি উঠে নামাজে যাবেন। ভোরের আলো ফোঁটার পরে যিনি সনাতন ধর্মের তিনি উঠে শংখ বাজাবেন, তার পূজা করবেন, একজন গায়ক সকালের মিষ্টি আলোয় তার গানের খানিকটা রেওয়াজ করবেন। সময় বাড়বে, কর্ম ব্যাস্ততা বাড়বে। উকিলের বাসায় মক্কেলরা আসবে। দুপুরের ক্লান্ত সময়টা বংশীবাদকের সুরেলা কন্ঠের ঘুম এনে দিবে, চারপাশে চিত্রশিল্পীর রঙের ছটা থাকবে। এটাই তো সৌন্দর্য্য। সকলে মিলে মিশে বসবাস করবে, একে অপরের উৎসব গুলোকে সম্মান দেখাবে। এমন পরিবেশে যে সন্তানেরা বেড়ে উঠবে তাদের মাঝে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের মূল্যবোধ তৈরী হবে। তাদের মাঝেই তো থাকবে উদারতা।


কিন্তু আমরা পরে আছি, কোন ধর্ম বেশী ফাল পারতেছে, কোন পথে অশ্লীলতা সহজ করা যায়, কোন পথে নিজের ক্ষমতা বাড়ানো যায়, কাকে কিভাবে দমানো যায় এইসব নিয়ে। আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছি ঠিকই কিন্তু কি লক্ষ নিয়ে জন্মেছি সেটিই আজও খুজে বের করতে পারিনা। মৃত্য আমাদের সবারই হবে জানি তবুও আমরা মারতে বড্ড ভালোবাসি। এতো গুলো গণহত্যা আমাদেরকে মনে এনে দিয়েছে পৈচাশিক শান্তি। আর এখন যারা এইসব নিয়ে সরব তাদেরকে দিচ্ছি বিগত আমলের মতন ট্যাগের রাজনীতি। ২৪ কে নাকি বিপ্লব বলা যাবে না। বললে সে পাকিস্তানের দালাল, পাকিস্তানের বীর্য খাওয়াদের দল। মজার বিষয় হলো আমরা এই ভূখন্ডের মানুষ বহুর শতাব্দীর পরিক্রমায় এমনিতেই নানান বীর্যের সংস্পর্শে চলে গেছি। এই পুরো ভারত উপমহাদেশে যারাই শাষণ করেছে তারাই এখানে তাদের বীজ ফেলে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তাদের বীজের সংস্পর্শে যে বারো-ভাতারী জাতির সৃষ্টি হয়েছে তারা বীজদাতাদের মতন বীর এবং সাহসী এখনও হতে পারিনি। আমাদের মধ্যে গোলামী করার অভ্যাস তৈরী হয়ে গেছে। 


যদি কোন ভারত প্রেমী মানুষ মনে করে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়াটা জঘন্য হয়েছে, তাহলে আমি মনে করে সে তার মূল্যবোধের জায়গা থেকে ঠিক আছে। কারণ সে ভারতের শাষণই চায়। কিন্তু ইতিহাস নিজেই সাক্ষী দিয়েছে যে, ভারতের দুইপাশে পাকিস্তান নামে নতুন রাষ্ট্র কেন গঠিত হয়েছিলো? এটা কি কঠিন কোন মাস্টার প্লান ছিলো নাকি তৎকালীন পরিস্থিতি এই ভূখন্ড গুলোকে আলাদা করতে বাধ্য করেছিল? তবে ভারত যেমন চাইছিলোনা তাদের ভূখন্ড ভেঙ্গে আলাদা রাষ্ট্র তৈরী হোক, তেমনি পাকিস্তানও চায়নি তাদের ভূখন্ডে আরো একটি রাষ্ট্র গঠিত হোক। আর সে কারণেই তারাও এই বাংলার ভূখন্ডে হত্যা যোগ্য চালিয়েছিলো। যদিও সে হত্যা যোগ্যের সঠিক ইতিহাস আমাদের কাছ থেকে ধামা চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।  তবে ইতিহাস ঘাটলে দেশ ভাগের পূর্বে ভারতে যে ধর্মীয় দাঙ্গা আর হত্যা যোগ্য চলেছিলো তার কাছে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গণহত্যা খুবই নস্যি। কিন্তু তাই বলে কি পাকিস্তানের সেই গণহত্যাকে আমি সাপোর্ট করবো? না, কখনোই না। তাদের হাতে আমার ভূমি রক্তাত্ম হয়েছে। বাংলার আকাশ বাতাস সে ৯ মাস কতটা ভয়ংকর ছিলো টা অনুভব করার মতন মূল্যবোধ আমার আছে। 


কিন্তু এর চেয়েও ভয়ংকর একটি ইতিহাস ধামা চাপা পরে আছে। সেসময় পাকিস্তানী বাহিনীর লক্ষ ছিলো এই ভূখন্ডে যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এবং যারা যুদ্ধে সহায়তা করছে, পুরো পাকিস্তানকে ভারতীয় মদদে যারা ভেঙ্গে ফেলার পায়তারা করেছে  তাদের প্রতিহত করা। কিন্তু সেসময় এই পাক বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে এই বাংলার বুকে সুবিধাভোগী বাঙ্গালীদেরই একটি অংশ নিজ দেশের, নিজ এলাকার মানুষদের উপর চালিয়েছে নরকীয় হত্যা যোগ্য। কচুকাটার মতন মানুষ জ*বাই করেছে। যার উপর পূর্ব শত্রুতা ছিলো, যার সম্পদের উপর লোভ ছিলো তাকেই ধরে ধরে মেরেছে। বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী কাওকেই রেহায় দেয়নি। দেশ ভাগের সময় যেসব মুসলমানরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে নিজের দেশ ভেবে এসেছিলো তাদের নৃশংস ভাবে হত্যা করে। আমার জন্মভূমি নওগাঁ এবং সান্তাহারে সে সময় শত শত বিহারীদের কচু কাটা করে। নারী-শিশু-বালক-বৃদ্ধ কেউওই রেহায় পায়নি। আমার পূর্ব পুরুষদের মুখে শুনেছি, আমাদের বর্তমান বাড়ী যুদ্ধের পূর্বে জঙ্গল ছিলো এবং এখানে গণকবর দেওয়া হয়েছিলো অসংখ্য নিরীহ বিহারীদের।  কিন্তু মজার বিষয় হলো হত্যাকারীরা কেউই রাজাকার বাহিনীর ছিলো না আর তারা যুদ্ধের পরে জণগণের রোষাণলে পরা জামায়াতের রাজনীতিও যোগ দেয়নি। এইসব হত্যাকারীদের পরবর্তীদের কিছু এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেছে, অনেককে মানবিক কারণে ছেড়ে দিয়েছে আবার অনেকে পালিয়ে থেকেছে। কিন্তু যারা পালিয়েছিলো তারা পরবর্তিতে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় আরো ক্ষমতাশালী হয়ে দাড়িয়েছে। এখন প্রশ্ন আপনার বিবেকের কাছে, ৭১ পরবর্তী ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দল কোনটি ছিলো? ছোট দল কিংবা যুদ্ধের পূর্বে পশ্চিম-পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা জামায়াত শক্তিশালী ছিলো নাকি তৎকালীন মুসলীমলীগ বা পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ শক্তিশালী ছিলো?


যাই হোক, এখন বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারত, এই দেশ গুলো এবং এদের খন্ড-বিখন্ড গুলোর বিষয় একটু পারিবারিক ভাবে উপমা হিসবে দেখা যাক। প্রায় সকল পরিবারেই সন্তানেরা বড় হলেই, মাচিউর হলেই বাবা-মার উপর অত্যাচার শুরু করে জমি ভাগ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অধিকাংশ বাবা মা’ই চায় তাদের জীবণকালে তাদের সম্পত্তি ভাগ না হোক। কেনোনা, সম্পদের মুষ্ঠি এক প্রকার শক্তি। যে শক্তি খন্ড খন্ড হয়ে গেলে হারিয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও তো ভাগ হয়। এই ভাগ নিয়ে আবার ভাই বোনদের মাঝে শুরু হয় যুদ্ধ। এবং সে যুদ্ধ এমন পর্যায়ে রূপ নেয় যার ফলে ভাই বোনদের দীর্ঘ সময় সম্পর্ক থাকে না, কেউ কারো মুখ দেখে না। কিন্তু একটা সময় পরে পরিস্থিতির কারণে অতিরিক্ত জুলুম করা ভাই যখন বুঝতে পারে যে সে অন্যয় করেছে এবং অন্য ভাই বোনদের নিকট ক্ষমা চায় - তখন সম্পর্কটা আবারও সুন্দর হয়। তারা সকলে মিলে আবারও একটি মুষ্টিবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু এই যে তাদের মাঝে আবারও যে মিল হলো, তাই বলে কি তারা আবার তাদের সম্পদ গুলোকে আগের মতন এক করে ফেলে? মোটেও না, বরং তারা একে অন্যকে সহায়তা করে নিজেদেরকে উন্নত করতে, সমৃদ্ধশালী হতে। 


পাকিস্তান আমাদের উপর যে গণহত্যা চালিয়েছে তার জন্য তারা ক্ষমা চেয়েছে। তারা অনুভব করেছে যে তাদের ভাইয়ের সাথে তারা কি অন্যায় করেছে। তারা এখন চায় বাংলাদেশের সাথে তাদের ভাতৃ সুলোভ সম্পর্ক পূণরায় প্রতিষ্ঠা করতে, তাদের young generation বাংলাদেশের গত বছরের গণ অভ্যুথানের সময় তাদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ছিলো খুবই খারাপ, তারপরেও তারা আমাদের রাস্তায় বুক চিতিয়ে থাকা ভাইদের সমর্থন জানিয়েছে বিশাল বিশাল সমাবেশে। ভারত যখন গণ অভ্যুথানের পর নানান প্রপাগান্ডা চালিয়েছে বাংলাদেশের নামে তখন পাকিস্থান থেকে আমাদের প্রতি এসে বিভিন্ন রকম সমর্থন। এটাই তো ভাতৃত্বের পরিচিয়। ৭১ এ গণ হত্যা চালিয়েছে বলে তাদের আমরা সারা জীবণ ঘৃণা করা যাবো বিষয়টা তো এমন নয়। পাকিস্তান তো মোটেই দুই দশক আমাদের শাসক ছিলো কিন্তু ইংরেজরা যে আমাদের ২০০ বছর চুষে খেয়েছে, মুলা দেখিয়ে গাধা দৌড়ানি দিয়েছে সেটা নিয়ে আমাদের কোন মনোকষ্ঠই নেই। আমরা ৭১ দেখে ৪৭, ৮৫, ৮৮ সব কিছু ভুলে গিয়েছি। কত হাজারো বীরের রক্ত আমাদের ভূখন্ডের সাথে মিশে আছে আমরা সেসব ভুলে গেছি। বীরদের ভূলে আমরা শিখেছি গোলামী। আমেরিকা তো ৭১ এ যুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছিলো বাংলার বুকে গোলা নিক্ষেপ করার জন্য, কিন্তু কই? আমেরিকাকে নিয়ে তো আমাদের কোন ঘৃণা নেই? আমরা তো বলিনা, আমেরিকা কে ক্ষমা চাইতে হবে? বরং আমেরিকার সিটিজেনশিপ পাওয়ার জন্য, আমেরিকার উন্নত জীবণে পা রাখার জন্য জীভ লক লক করে! 


সেই দেশ ভাগের সময় থেকে থেকে আজ অবধী ভারত আমাদের সাথে যা করছে তা পাকিস্তানের শোষনের তুলনায় কিছুই নয়। যদিও আমাদের চোখে কাঠের চশমা, সকল open truth আমাদের কাছে মিথ্যে।


কিন্তু একটা সময় এই ভারত যদি বুঝতে পারে যে তারা আমাদের সাথে যা যা অন্যায় করেছে টা উচিত হয়নি, তারা যদি সত্যিই অনুতাপ করে, জাতিগত ভাবে তারা আমাদেরকে তাদের শোষণের ভূখন্ড না ভেবে ভাই ভাবতে পারে, আমি মনে করি মোঘলীয় আমলে এই ভারতীয় উপমহাদেশ যেমন একটি বিশাল শক্তি হয়ে উঠেছিলো তেমনি এ যুগে এসে নিজেদের ভূমিকে অখন্ড না করেই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মুষ্টিবদ্ধ হাত একত্রিত হলে আবারো সেই শক্তি পূণরাত্থিত হবে।


২৪ কে মানলেই কেউ রাজাকার, পাকিস্তানের গোলাম আর মুক্তিযুদ্ধকে মানলেই সে ফাসিস্ট পন্থি এইসব সব নোংরা ট্রমা থেকে জাতিগত ভাবে আমাদের বের হওয়া উচিত। ৭১ নাকি ২৪ এই প্রশ্নটি অনেকটা মা আগে নাকি বউ আগে এই প্রশ্নের মতন। মা তো মা, মায়ের বিকল্প নেই কিন্তু পরিবারের গঠনতন্ত্রকে ত্বরান্বিত করতে বিয়ে করতে হয়, ঘরে বউ আনতে হয়। আর তখন মা এবং বউ, দুইজনই পরিবারের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হয়ে ওঠে। তেমনি এই দেশে ৭১ আমাদেরকে স্বাধীন ভুখন্ড, স্বাধীন জাতীয়তা দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে ৯০, ২৪ এইসব এসেছে দেশের ভঙ্গুর দশাকে মেরামতের জন্য। 


আমাদের ট্যাগিং রাজনীতি, কিছু দেখলেই খট করে কমেন্ট করার মানুষিকতা, অন্যের পেছনে আঙ্গুল দেওয়ার অভ্যাস বন্ধ করা উচিত।  নয়তো এই দেশের মসনদে যেই বসুক না কেন, কারো দ্বারাই আমাদের জাতিগত উন্নতি সাধিত হবে না। ক্ষমতার মসনদে থেকে রুটি ছিটাবে আর টুট মারা যাবে আমাদের সবার।


রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো নির্মাণ মানেই জাতিগত উন্নতি নয়, প্রয়োজন জাতির মানুষিক পরিবর্তনের। চোখ থেকে কাঠের চশমা খুলে একটু সত্য আলোর দিকে তাকান। সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানুন। নিরপেক্ষ ভাবে ভাবার অভ্যাস করুন। আওয়ামিলীগের যারা রাঘব বোয়াল তারা সময় মতন নিজেদের আখের গুছিয়ে নিজেদেরকে সেফলি সরিয়ে নিয়েছে কিন্তু তাদের সাইকোলজী দিয়ে গেছে আপনাদের মস্তিষ্কে। যে সাইকোলজী কোন জাতীকে একদিনে ধ্বংস করার নয় কিন্তু একটি জাতীকে যুগের পর যুগ পঙ্গু করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আদর্শিক দিক থেকে আপনি যেকোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করতেই পারেন। হোক সেটা আওয়ামীলীগ, বিএনপি কিংবা জামাত কিংবা অন্য কোন দল। কিন্তু সেই দল যদি তার আদর্শিক জায়গা থেকে সরে যাবার পরেও আপনি যদি সেই দলকে মুখবাজি করে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেন, তাহলে আপনার চেয়ে মূর্খ আর বিবেকহীন আসলেই আর কেউ নাই। 

লিখাঃ আকিব মাহমুদ


Previous Post Next Post